সোহেল চৌধুরীর কবিতা ‘আমার মায়ের সুঘ্রাণ’


মুক্তির আলো প্রকাশের সময় : ২৩/০৫/২০২৩, ৮:০৪ অপরাহ্ন
সোহেল চৌধুরীর কবিতা ‘আমার মায়ের সুঘ্রাণ’

মাগো, তোমার জঠর থেকে কেন আমায় দেখালে এই ধরণির আলো?

আমি তো অনেক অনেক ভালো ছিলাম,

তোমার জরায়ুতে অনেক বেশি নিরাপদ ছিলাম।

কলুষ পৃথিবীর কালিমা আমায় ছুঁতে পারত কি?

 

মাগো, কতদিন দেখি না তোমায়।

জানি তুমি স্বর্গে আছো-

আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় নরকের কীট

আমিও পৃথিবী নামক নরকের বাসিন্দা।

কীভাবে তোমার কাছে যাব, বলো?

আমার কি শাপমোচন হবে না?

আমি কি তোমার মতো পুত-পবিত্র হতে পারব না?

 

মা, তোমার মনে আছে?

তোমার জায়নামাজের পাশে শীতল পাটি আর নকশি কাথায় আমায় ঘুম পাড়াতে।

আমার নাকডাকা ঘুম, আর তোমার সারা রাত্রির ইবাদত শেষে,

কচি ভোরের আলোয় আমাকে জাগিয়ে তুলে হরিৎ প্রকৃতির রং দেখাতে,

পাখালির কলতানে মুখরিত ভোরের সতেজ বাতাসে তোমার আঙুল ধরে আমি হাঁটতাম।

আমাদের পদ্মদিঘির শালুক তোলা,

পানকৌড়ির ডাক,

নুয়ে পড়া শিমুলের ডাল, ঘুঘু পাখির ছানাদের ক্ষুধার আকুতি।

শীতে খেজুর রস, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, বিন্নিভাত,

বৈশাখে আম-কাঁঠালের ম-ম গন্ধ

আজ এখন কোথাও যে কিচ্ছু নেই।

 

নেই মাটির সেই সোঁদা গন্ধ, নেই আর বকুলতলা!

বরই, জামরুল, শরীফা, কালোজাম, কামরাঙা, কদবেল,

চালতা, চালকুমড়া আর আমার রঙিন রসালো কৈশোর।

নেই আর তোমার ডালিম গাছ,

লিচু বাগান, কাঁঠাল বাগান, দিঘিপাড়ে খেজুর গাছের সারি,

নারকেল-সুপারির গাছগুলো।

 

কালের সাক্ষী হয়ে আমিই শুধু বেঁচে আছি,

অর্বাচীন নরকঙ্কাল রূপ ধারণে,

ইদানীং পাঁজরের হাড়ে খয়েরি দাগ পড়েছে,

নিকোটিন গিলে খাচ্ছে হাইপোথ্যালামাসের নিউরন।

 

রক্তকণিকারা পীতাভ-সবুজ হয়ে গেছে।

হৃৎপিণ্ড, যকৃত, বৃক্ক- সবই অকেজো।

মরণব্যধি কার্সিনোমা বাসা বেঁধেছে দেহে।

মাগো, ঘুমহীন তীব্র ব্যথায় কাটে রাত।

বহুদিন কাঁদতে পারি না,

স্বপ্ন দেখি না কোটি বছর।

মাগো মনে আছে?

তুমি বলেছিলে মন্বন্তরের গল্প,

আমি দেখেছি ৭৪’র দুর্ভিক্ষ।

তুমি বলেছিলে- গোলাভরা ধান বিলিয়েছিলেন বাবা,

হাতের কঙ্কন বেঁচে করিয়েছিলে কাঙালি ভোজ।

পবিত্র তোমরা আজ স্বর্গবাসী।

আর আমি দুষ্টচক্রের হাতে নিষ্পেষিত।

 

আমাকে গিলে খাচ্ছে বালিচড়ের করাল কাঁকড়া।

ভূমিদস্যুরা বাবার তাবৎ জমি হাতিয়ে নিয়েছে।

‘সম্বল তার কম্বলখানি’র মতো তোমাদের শেষ নিশ্বাস ফেলা ভিটেটুকুই আছে।

মাগো, তোমার দেওয়া জমিতে মসজিদ আর এতিমখানা চালিয়ে নিচ্ছি।

আমি তো কিচ্ছুই করতে পারিনি, মা।

আমাকে তুমি শুধু দোয়া করো।

 

অক্ষরে অক্ষরে মোহন বাঁশির সুর তুলব,

স্বদেশ আমার, মাটি-জল,

বাঙালির প্রাণে সবুজ বাংলাকে করব প্রাণময়,

ধানের শীষে শিশির পড়ার শব্দে মাতাল হব,

শস্যমঞ্জুরির সুবাস নিয়ে তোমাদের কবরে শায়িত হব।

ফিরে যাবই তোমার সেই আল্পসের রং দিয়ে সাজানো স্বদেশ মাতৃভূমে।

মা, তুমি তোমার সন্তানেরে দোয়ায় রেখো,

বিপদে যেন ভয় না পাই

স্বর্গে যেন তোমার দেখা পাই

এ আমার আশা, আমার বিশ্বাস, এ আমার স্বপ্ন।