যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে সহজ হবে হজ পালন


মুক্তির আলো প্রকাশের সময় : ২৩/০৫/২০২৩, ৬:৪৯ অপরাহ্ন
যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে সহজ হবে হজ পালন

হজ মহান আল্লাহর নির্দেশ এবং একটি ইবাদত। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হজ। আরবি হজ শব্দের অর্থ সংকল্প করা বা ইচ্ছা করা। কোরআনুল কারিমে ১০২ বার হজ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। হজ আর্থিক এবং শারীরিক ইবাদত। তাই আল্লাহ তাআলা আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিপূর্ণভাবে হজ সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ফরজ হজের উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা।

আল্লাহ তাআলা হজের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হজের সময় নির্দিষ্ট মাসসমূহ। অতএব এ মাসসমূহে যে নিজের ওপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভালো কাজের যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর। নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাকওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্নগণ, তোমরা আমাকে ভয় কর।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৭)

 আর নির্ধারিত সময়ে আল্লাহর জন্য নবীজীর দেখানো পথে কাবা শরিফ তাওয়ায়, সাফা-মারওয়া সায়ী, আরাফা-মুজদালিফায় অবস্থান, মিনায় কংকর নিক্ষেপসহ কুরবানি ও মাথা মুণ্ডন করার মতো নির্ধারিত কাজ সম্পাদন করার নাম হজ। কোরআন সুন্নায় হজের গুরুত্ব ও ফজিলত ওঠে এসেছে। কী সেসব গুরুত্ব ও ফজিলত? ঘনিয়ে আসছে হজ।
 
এরই মধ্যে বিশ্বের সব দেশ থেকে হজযাত্রীরা মক্কা-মদিনায় পৌঁছাতে শুরু করেছেন। আর গত ২১ মে থেকে বাংলাদেশি হজ যাত্রীরা সৌদিতে পৌঁছাতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশি ও বাংলা ভাষাভাষী হজযাত্রীদের যাওয়ার আগে পরে কিছু নিয়মকানুন জানা থাকলে সহজেই যে কোনো সমস্যা থেকে আপনি আপনার হজটি সহজ করে নিতে পারবেন। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক।
 
মক্কা-মদিনায় পৌঁছানোর পরে যে বিষয়গুলো জেনে নেয়া খুবই জরুরি-  
 
*দেশে থাকার সময় আপনার প্যাকেজের সুবিধাদি যেমন মক্কা ও মদিনায় থাকা-খাওয়া, কোরবানিসহ অন্য সুবিধার কথা হজ এজেন্সির কাছ থেকে লিখিতসহ খুব ভালোভাবে বুঝে নিন। সৌদি আরব গিয়ে তা মিলিয়ে নিতে পারবেন। দেশটিতে অবস্থানকালে ট্রাফিক আইন মেনে চলুন। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লে রাস্তা পার হতে হবে। রাস্তা পার হওয়ার সময় অবশ্যই ডানে-বাঁয়ে দেখেশুনে সাবধানে পার হতে হবে। কখনো দৌড়ে রাস্তা পার হবেন না। দেশটিতে ট্রাফিক আইন কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হয়। হজের জন্য যে বিমান বন্দর থেকে আপনি বের হবেন না কেন, আপনার জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি রাখা থাকে। আর বিমানবন্দর থেকে মোবাইল ফোনের সিম দেবে আপনার পাসপোর্ট  নম্বর দিয়ে।    
 
*কাবা শরিফ মানে মসজিদুল হারামের ভেতর ও বাইরে এবং মদিনায় মসজিদে নববীর ভেতরে কিছুদূর পরপর জমজম পানি (স্বাভাবিক ও ঠান্ডা) পান করার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাণভরে জমজম পানি পান করতে পারবেন। কোনো ধরনের অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় পড়লে বাংলাদেশ হজ মিশনের মেডিকেল সদস্যের (চিকিৎসক) সঙ্গে যোগাযোগ করুন। হজযাত্রীদের তথ্য, হারানো হজযাত্রীদের খুঁজে পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ হজ মিশনে অবস্থিত আইটি হেল্প ডেস্ক সাহায্য করে।
 
*তাওয়াফ, সাঈ করার সময় অহেতুক কথা বলা বা ছবি তোলা থেকে বিরত থাকুন। টাকাপয়সা নিরাপদে রাখুন। আপনার হজ এজেন্সি আপনাকে যথাযথ সুবিধা (দেশ থেকে আপনাকে থাকা-খাওয়াসহ অন্য যেসব সুবিধার কথা বলেছিল) না দিলে আপনি মক্কা ও মদিনার বাংলাদেশ হজ মিশনে অভিযোগ জানাতে পারেন। এতেও আপনি সন্তুষ্ট না থাকলে সৌদির ওয়াজারাতুল হজ (হজ মন্ত্রণালয়) বরাবর লিখিত অভিযোগ করতে পারেন।
 
*মদিনা থেকে যদি মক্কায় আসেন, তাহলে ইহরামের কাপড় সঙ্গে নিতে হবে। মসজিদে নববীতে নারীদের জন্য প্রবেশপথ ও নামাজ পড়ার আলাদা জায়গা আছে। রিয়াজুল জান্নাতে নারীদের প্রবেশের সময়সূচি: অবশ্যই মসজিদে নববিতে প্রবেশের আগে ডিজিটাল বোর্ড দেখে জেনে নিন সময়টি। কারণ সেখানে নারীদের নির্দিষ্ট সময়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।
 
* হজযাত্রীদের অতিরিক্ত ভিড়ে পথ হারানোর আশঙ্কা থাকে। তবে এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এ ব্যাপারে হজযাত্রীদের সচেতন থাকতে হবে। তবে আপনি যে হোটেলে উঠেছেন; সেই হোটেলের ফোন নম্বর ও ঠিকানা দেয়া বেল্ট থাকে সেটি হাতে পরে নিতে হবে। মক্কা বা মদিনায় হারিয়ে গেলে সেই হাতের  বা কোমরের বেল্ট দেখালে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আপনিকে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবে বা সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দেবে।
 
* মক্কা-মদিনায় প্রচুর ফলমূল ও ফলের রস পাওয়া যায়। এগুলো কিনে খেতে পারেন।
 
হজের সময় যে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে-
 
*হজের পাঁচ দিন মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা, মিনায় অবস্থান করতে হয়। তাই হাতব্যাগে এক সেট অতিরিক্ত ইহরামের কাপড় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখবেন। কোনো কোনো হজযাত্রী হেঁটে হজের আমলগুলো করে থাকেন। যেমন মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। আরাফাত থেকে মুজদালিফার দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। মুজদালিফা থেকে মিনার দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার। এসব স্থানবিশেষে হেঁটে যেতে এক থেকে দুই ঘণ্টা লাগতে পারে। দিনের বেলায় বাইরে বের হলে ছাতা সঙ্গে নেবেন। মুজদালিফায় রাতে থাকার জন্য প্লাস্টিকের পাটি ব্যবহার করতে পারেন। সঙ্গে কিছু শুকনা খাবার রাখতে পারেন। মক্কাসহ বিভিন্ন জায়গায় ছাতা, পাটি কিনতে পাওয়া যায়।
 
* মিনার মানচিত্র থাকলে হারানোর ভয় নেই। মিনার কিছু স্থান চিনে নিজের মতো করে আয়ত্তে আনলে এখানে চলাচল করা সহজ হয়। যেমন জামারা (শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের স্থান), মসজিদে খায়েফ, মিনার তিনটি সেতু (বাদশাহ খালেদ ব্রিজ ১৫ নম্বর, বাদশাহ আবদুল্লাহ ব্রিজ ২৫ নম্বর, বাদশাহ ফয়সাল ব্রিজ ৩৫ নম্বর), হাঁটার পথ (টিনশেড নামে পরিচিত)। এখানে সাতটি জোন রয়েছে। মিনার বড় রাস্তাগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম ও নম্বর রয়েছে।
 
* রাস্তার নাম ও নম্বর জানা থাকলে মিনায় চলাচল সহজ হয়। পথ হারানোর আশঙ্কা কম থাকে। বড় রাস্তাগুলো হলো বাদশাহ ফয়সাল ৫০ নম্বর রোড, আলজাওহারাত ৫৬ নম্বর রোড, সুক্কল আরব ৬২ নম্বর রোড, কিং ফাহাদ ৬৮ নম্বর রোড। মিনায় রেলস্টেশন ৩টি। মুজদালিফায় রেলস্টেশন ৩টি। এ ছাড়া রয়েছে সুড়ঙ্গপথ, টানেল, পায়ে চলার রাস্তা, হাসপাতাল, মসজিদ, পোস্ট অফিস, মিনার বাদশাহ বাড়ি, রয়েল গেস্টহাউস (রাজকীয় অতিথি ভবন) মোয়াচ্ছাসা কার্যালয়।
 
*মক্কা, মদিনা, মিনা, আরাফাতের মানচিত্র কাগজে মুদ্রিত বা অনলাইনে ডিজিটাল ছবি আকারে পাওয়া যায়। সম্ভব হলে মানচিত্র দেখুন, তাহলে ওখানকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন।
 
* মিনায় মোয়াল্লেম নম্বর বা তাঁবু নম্বর জানা না থাকলে যে কেউ হারিয়ে যেতে পারেন। ধরা যাক, মিনার তাঁবু নম্বর ৮/৫৬। ওপরের সংখ্যা তাঁবু নম্বর ৮, নিচের সংখ্যা ৫৬ হলো রাস্তার নম্বর। মোয়াল্লেম অফিস থেকে তাঁবুর নম্বরসহ কার্ড দেয়া হয়, তা যত্নে রাখতে হবে। বাইরে বের হওয়ার সময়ও কার্ডটি সঙ্গে রাখুন। সমস্যা এড়ানোর জন্য যে তাঁবুতে অবস্থান করবেন, সেই তাঁবু চিহ্নিত করে নিন।
 
*মিনায় জামারা থেকে আপনার তাঁবুর অবস্থান, তাঁবু থেকে মসজিদুল হারামে যাওয়া-আসার পথ সম্পর্কে ধারণা নিন। ভিড় এড়াতে কেউ কেউ হেঁটে সুড়ঙ্গ (টানেল) পথ দিয়ে মসজিদুল হারামে পৌঁছান। হাঁটার পথ চিনতে স্থানীয় (বাংলাদেশি কাউকে বললে দেখিয়ে দেবেন) বা গুগল ম্যাপসের সহায়তা নিতে পারেন। অনেকে ট্যাবলেট কম্পিউটার বা আইফোন নিয়ে যান। রাস্তাঘাট, অবস্থান ইত্যাদি জানতে হজ ও পিলগ্রিম অ্যাপের সহায়তা নিতে পারেন।
 
*আরাফাতের ময়দানে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে খাবার, ফল, ফলের রস ইত্যাদি দিয়ে থাকে। ওই সব খাবার আনতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়তে হয়। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
 
* মিনায় চুল কাটার কর্মী পাওয়া যায়। তাদের সহায়তা নিন। নিজেরা নিজেদের চুল কাটবেন না, এতে মাথা কেটে যেতে পারে।
 
হারিয়ে গেলে কী করবেন-
 
সৌদি আরবে হজ করতে গিয়ে নতুন পরিবেশে যে কেউ হারিয়ে যেতে পারেন। দলছুট হয়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া যাবে না। ঠান্ডা মাথায় নিচের কাজগুলো করার চেষ্টা করতে হবে।
 
আপনার ফোন চালু থাকলে, সঙ্গীকে ফোন দিতে পারেন। নিজের ফোন দিয়ে কল করা সম্ভব না হলে, সেখানে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে পাবেন, তাদের সাহায্য নিতে পারেন। তাদের সাহায্য নিয়ে মক্কা ও মদিনায় বাংলাদেশ হজ অফিসে আপনাকে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারেন। বাংলাদেশ হজ অফিস মক্কার ঠিকানা: ইব্রাহিম খলিল রোডে মিসফালাহ কার পার্কিংয়ের উল্টা দিকে। একাধিক কাগজে নিজের এবং সঙ্গীর ফোন নম্বরসহ ঠিকানা লিখে সঙ্গে নিতে পারেন।
 
মদিনায় হজ অফিসের ঠিকানা: মসজিদে নববীর উত্তর (ওহুদ পাহাড়) দিকে কিং ফাহাদ গেট, অর্থাৎ ২১ নম্বর গেট দিয়ে বের হয়ে বাঙালি মার্কেটের পরে বাংলাদেশ হজ অফিস।
 
কত টাকা সঙ্গে নেবেন
 
একজন হজযাত্রীর খরচ কেমন হতে পারে। একটা ধারণা নেয়া যাক। স্থান–কাল–পাত্রভেদে খরচ কমবেশি হতে পারে। সাধারণত হজ প্যাকেজে খাবারের ব্যবস্থা থাকে। এর বাইরে সম্ভাব্য খাওয়ার খরচ ১ হাজার ৫০০ রিয়াল। কোরবানি ৮০০ রিয়াল, মিনায় ৫ দিনের খরচ ৫০০ রিয়াল, ঐতিহাসিক স্থান, জেদ্দায় বেড়ানো ৫০০ রিয়াল এবং আনুষঙ্গিক ৩০০ রিয়াল। এর বাইরে কেনাকাটা যা করবেন। খেজুর প্রতি কেজি ১০ থেকে ১০০ রিয়াল, জায়নামাজ প্রতিটি ৫ থেকে ২০০ রিয়াল, প্রতিটি টুপি ১ থেকে ১০০ রিয়াল ও তসবিহ ১ থেকে ১০০ রিয়াল।
 
* ১ রিয়াল = প্রায় ৩০ টাকা। এটি সময় পরিবর্তনশীল।
 
তালবিয়া-
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্​দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্​ক, লা শারিকা লাক। সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন  করুন আপনার হজ। আমিন।